![]() |
সে জানে না যে, সে নিজেই একটি ফুল! |
করোনার বছর। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতসহ সবকিছুই কেমন যেন থমথমে। ব্যস্ত শড়কেও পিনপতন নীরবতা। মাসকট্ প্লাজা, যমযম টাওয়ার, আমেনা বিগ বাজার ও ফাইভ স্টারের মতো নামি-দামি মার্কেটগুলোতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা হচ্ছে। আজ এই গোধূলি বেলায়— ডিয়াবাড়ির লেকপাড়ে কিন্নর-কিন্নরীদের বেশ আড্ডা জমে থাকতো; বেঞ্চগুলো সাঁটানোই আছে, টেবিলগুলোও পাতানো আছে, তবে তা শূন্য। ফুসকার দোকানগুলোতে বড়বড় তালা ঝুলছে। লেকের পানিতে দুই আসনের কাপল রঙ্গিন বোর্ডগুলো, এলোমেলো ভেষে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, করোনা তাদের পরাস্ত ঘোষণা করে, বিজয়ী বেশে পুরো লেকটা দখল করে নিয়েছে। উত্তর আকাশ থেকে, বিরাটকার দেহ নিয়ে, শাঁইশাঁই করে একটি বিমান উড়ে গেলো এয়ারপোর্টে। লেকের পানিতে স্পষ্টভাবে তার ছায়া ভেষে উঠলো। এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি (চারপাঁচ সন্তানের পিতা হবে) বাদামের ঝুলি গলায় নিয়ে আমার দিকে আসছে। ইচ্ছে না থাকার পরেও লোকটির চেহারার দিকে তাকিয়ে— ২০ টাকার বাদাম কিনলাম। এই থমথমে পরিবেশে কে জানে (?) কেউ ১০ টাকার বাদাম কিনেছে কি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মামা! আজ কতটাকার বাদাম বিক্রি হলো? লোকটি কপাল কুঁচকিয়ে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে, ভারী গলায় জবাব দিলো— আপনিসহ দেড়শত টাকার! আমি দ্বিতীয়বার কোনকিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। বাদাম বিক্রেতা চলে যাওয়ার পর, পিছন থেকে একটি মেয়ে শিশু ছুটে এলো। বড়জোর ক্লাস থ্রি-তে পড়ার উপযোগী হবে। কী ফুটফুটে উজ্জ্বল ফর্সার চেহারা! কাঁধ ছুঁয়েছে এলোমেলো কালো কেশ। টানাটানা ভ্রু। যেন চাঁদের আধখানা! আমি কিছু বলেওঠার আগেই সুদর্শনা বললো, ভাইয়া! খুব তাজাতাজা ফুল এনেছি কিনবেন? আজ একটাও বিক্রি করতে পারি নি। না-ও না ভাইয়া! দু'টো কিনলে একটা ফ্রী দিয়ে দিবো! আমি 'থ' হয়ে মায়াবতীর মায়ামেশা কথাগুলো শুনছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে একটা ফ্রী দিয়ে দিবে, তাতে তোমার লস্ হবে না? পুষ্পবতী জবাব দিলো, লস্ হলেও দিয়ে দিবো। আমার হাতে থাকা বাদামের প্যাকেটটা তাকে দিচ্ছিলাম। সে নিতে রাজি হচ্ছিলো না। ফুল কেনার শর্তে রাজি হলো। আমি ৩৫ টাকা দিয়ে একটি তাজা গোলাপ ও ২৫ টাকা দিয়ে কিছু কাঠগোলাপ কিনলাম। গোলাপটি পূনরায় তার হাতে ফিরিয়ে দিতে— পুষ্পিতা ভ্রূদ্বয় উঁচিয়ে বললো, ভাইয়া! আপনি এটা নিবেন না? ফুলটা তার ঝুলেপড়া চুলগুলো সরিয়ে, কানের ডগায় গুজিয়ে দিলাম। তার মনকাড়া ও টোলপড়া গালের হাসিতে আমার বুকটা ভরে গেলো। ইচ্ছে করছিলো, তার পছন্দমতো খাবার খাওয়াবো। আশপাশের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় ১০০ টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, এটা একান্তই তোমার জন্য। কিছু খেয়ে নিও। টুকটুকে লাল গোলাপটা, তার নিকষ কালো চুলের ফাঁকে বেশ লাগছিলো!
আচ্ছা, তোমার নাম কি? আমার নাম তাসলিমা। স্কুলে যা-ও না? ২ কি'বা ৩ শো মিটার দূরের এক বস্তির দিকে ইশারা করে বললো, ঐখানে আমার বাড়ি। বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমার 'মা' পাগলি। আমি স্কুলে গেলে আমার মা'কে কে খাওয়াবে?
আহ! কী করুণ ভাষ্য আর কী নিদারুণ প্রশ্ন! আমি নির্বাক হলাম। আমার হতবাক নীরব চোখের দিকে তাকিয়ে, পিচ্চি তাসলিমা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো, তার এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই; তাই আমার চোখের সামন দিয়ে, ফুলের ঝুড়ি হাতে নিয়ে, আস্তে-আস্তে আড়াল হলো সে...
(বাইশ এক বিশ)
আর্টিকেলটি ভারতের র বি বা স রী য় পত্রিকায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment